জাতীয় স্তরে নয়টি আর আন্তর্জাতিক স্তরে চারটি সোনার মেডেল রয়েছে নিজের ঝুলিতে। আরও একটি আন্তর্জাতিক স্তরের সোনার মেডেল একটুর জন্য হাতছাড়া হয়ে গেল। অনুশীলন কালে পায়ে চোট পাওয়ায় মালেশিয়ার মাস্টার্স অ্যাথেলেটিক্স মিটে হাই জাম্পে সোনার বদলে রূপো আর ব্রোঞ্জ পদক প্রাপ্তি হল। দেশে ফিরেই আবার অনুশীলনে ডুব দিয়েছেন। সোনার মেডেল যে জিততেই হবে! অসাধারণ এই মনের জোর যার, তার বয়স মাত্র সত্তরের কিছু বেশী। ২০০৯ সালে কর্মজীবন থেকে অবসর নেওয়ার পরই শুরু করেন জীবনের দ্বিতীয় ইনিংস। আর সেই ইনিংস যেন একেবারে ‘বাপী বাড়ি যা’ টাইপের।
সেপ্টেম্বর মাসের ১৪ তারিখ চেন্নাই থেকে ৪৬ জনের একটি ভারতীয় দল মালয়েশিয়ার কুয়ালালামপুরে রওনা দেয়। সেই দলে পশ্চিমবঙ্গ থেকে যে তিনজন ডাক পেয়েছিল তাদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন প্রলয় ব্যানার্জী। সেখানেই হাই জাম্পে জোড়া পদক জেতেন তিনি। তার আগে জানুয়ারীর ১৯ তারিখ শ্রীলঙ্কায় অনুষ্ঠিত ইন্টারন্যাশনাল মাষ্টার্স এ্যাথলেটিক্স ১০০ মিটার দৌড়ে পদক ছিনিয়ে আনেন।
কোচবিহারের জেনকিন্স স্কুলে পড়ার সময় থেকেই খেলাধুলার প্রতি ভালোবাসা। স্কুলের অ্যানুয়াল স্পোর্টস এর ব্যক্তিগত ইভেন্টে প্রত্যেক বছর চ্যাম্পিয়ন হতেন তিনি। ১০০ মিটার, ২০০ মিটার দৌড়, হাই জাম্প, লং জাম্প- সবেতেই অদ্ভুত দক্ষতা ছিল তাঁর। তৎকালীন ভিক্টোরিয়া কলেজ বর্তমানে আচার্য ব্রজেন্দ্রনাথ শীল কলেজের পড়ার সময়ও অ্যাথেলেটিক্সে ব্যক্তিগত চ্যাম্পিয়ন হতেন। ত স্কুল কলেজ ছাড়াও জেলাস্তরেও সে সময় খেলেছিলেন তিনি। তবে ফুটবল ক্রিকেট দুটোতেই সমান দক্ষতার সঙ্গে খেললেও ভালোবাসাটা বরাবরই অ্যাথলেটিক্স এর প্রতি একটু বেশিই ছিল। সে সময় কোচবিহারে অ্যাথলেটিক্সে সেরকম কোচ ব্যাপারটা ছিল না। স্কুল কলেজের মাঝামাঝি সময়ে কলকাতা থেকে হরবিন্দর সিং নামে একজন কোচ এসছিলেন কোচবিহারে। তার কাছে ৭ থেকে ১০ দিনের ট্রেনিং নিয়েছিলেন তিনি। বাকি যতটুকু সবটাই নিজের মতো করে নিজেকে তৈরি করেছেন। প্রলয় বাবুর মতে এখন যে রকম কোচবিহারে খেলাধুলার একটা সুযোগ বা সুবিধা রয়েছে আমাদের সময় ততটা ছিল না। যতদিন মহারাজা ছিলেন, কোচবিহার খেলাধুলায় যথেষ্ট এগিয়েছিল। কিন্তু তারপরে খেলাধুলার দিকে কোচবিহার অনেকটাই পিছিয়ে যায়। সেই সময়ে বাড়ির অবস্থাও খুব ভালো যে ছিল তা নয়, কলকাতায় গিয়ে যদি ট্রেনিং নিতে পারতাম তবে হয়তো সে সময় এশিয়া অব্দি গেলেও যেতে পারতাম, আক্ষেপ ঝরে পড়ে তার গলায়।
এই খেলার সূত্র ধরেই কলেজ জীবনে পেয়ে যান জীবন সঙ্গিনীকে। প্রসঙ্গত, প্রলয় বাবুর শ্বশুর বাড়ির সকলেই ছিলেন খেলা পাগল। শ্বশুর মশাই ভবেশ চন্দ্র গুহ (মেঘা দা) ছিলেন মহারাজার ফুটবল টিমের ক্যাপ্টেন। দাদা শ্বশুর দ্বিজেশ চন্দ্র গুহ (ছানা গুহ) ছিলেন কোচবিহার মহারাজার ফুটবল টিমের কোচ এবং জেনকিন্স স্কুলের ফিজিকাল ইন্সট্রাক্টর। রাজ আমলে খেলাধূলায় কোচবিহার একসময় অনেক ওপরের দিকে ছিল। কিন্তু কোচবিহার জেলা হয়ে যাওয়ার পর, খেলার দিকে কোনো রকম নজর দেয়নি কোনো সরকারই। আর তাই মাঝের বেশ কিছু বছর খেলাধূলায় কোচবিহারে একটা শূন্যতা দেখা দিয়েছিল। শুধু এরকম কিছু মানুষ অদম্য মনের জোর আর ইচ্ছাশক্তিকে সঙ্গে করে খেলার মাঠে লড়াই চালিয়ে যাচ্ছিল। যদিও পেশা ও সংসার সামলে খেলার দিকে তেমন ভাবে মনযোগ দিতে পারেন নি। কিন্তু খিদেটা থেকেই গিয়েছিল। তাই আবার বিরতি কাটিয়ে চাকরি জীবনে অবসরের পর মাঠে ফিরে আসা।
জীবনের উপর দিয়ে কম ঝড় যায়নি। ২০০৯ সালে ক্যান্সারে স্ত্রী বিয়োগ। 2011 সালে অ্যাক্সিডেন্টে একমাত্র ছেলে মৃত্যু। কোন কিছুই টলাতে পারেনি তাকে নিজের সাধনা থেকে। এখন পুত্রবধূ আর নাতনিকে নিয়েই তার সংসার। নিজের প্রয়োজনে বাইক চালিয়ে আজও চলে যান দিনহাটা, মাথাভাঙ্গা, তুফানগঞ্জে। নিজেকে ফিট রাখার জন্য যা যা করণীয় সবটাই করেন। চুটিয়ে আড্ডা মারেন, গান করতে ভালবাসেন। সবটাই করেন ভালোবেসে।এত মনের জোর আসে কোথা থেকে? প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন,” এই মনের জোরটাই সম্বল”। নিজের বয়সে বন্ধুদের চাইতে অল্প বয়সী বন্ধু বেশি। এদের কাছ থেকে অনেক কিছু পাওয়া যায়, অনেক নতুন কিছু জানা যায়। নিজেকে আপডেট রাখার এত ভাল উপায় আর কিছু আছে কি! তাই সবার সঙ্গে মন খুলে মেশেন। জীবনের একটাই ‘কি ওয়ার্ড’- নিজেকে রঙিন রাখতে হবে। মনের বয়স বাড়তে দিলে চলবে না। তাই নতুন প্রজন্মের প্রতি তার আহ্বান, মোবাইল ছেড়ে পড়াশোনার সাথে সাথে মাঠকে ভালবাসতে শেখো। আর একটু বয়স্কদের প্রতি বার্তা হল, মনটাকে সজীব রাখুন, একটু নিয়ম মেনে চলুন, দিনে ৩০-৪০ মিনিট একটু হাঁটাহাঁটির মধ্যে থাকুন। হালকা এক্সারসাইজ করুন আর সবচেয়ে বড় কথা মনের বয়স বাড়তে দেওয়া যাবে না।
কোচবিহার মাস্টার্স স্পোর্টস অ্যাসোসিয়েশন জেনারেল সেক্রেটারি তিনি। এমজেএম স্টেডিয়ামে সপ্তাহে তিন দিন চলে তাদের কোচিং ক্যাম্প। অ্যাথলেটিক্স আগ্রহ রয়েছে অথচ পয়সা বা অন্য কোনো কারনে কোচিং করার সুযোগ পায়না তাদের এখানে বিনামূল্যে খেলার কোচিং দেওয়ার ব্যবস্থা রয়েছে, জানালেন প্রলয় বাবু। মালেশিয়ার সেই চোট টা এখনও ভোগাচ্ছে। তাই ডাক্তারের পরামর্শ মেনে কদিন একটু রেস্টে আছেন তিনি। এখন অনেকটাই ঠিক। আর কদিনের মধ্যেই আবার মাঠে অনুশীলন করতে দেখা যাবে সত্তরের এই চির যুবককে। সোনা যে আনতেই হবে!