নিজস্ব প্রতিনিধি: ৩০০ বছরের প্রাচীন নারায়ণপুরের জমিদার বাড়ির দুর্গা পুজো| এই পুজোর পিছনেও রয়েছে ইতিহাস| আজ থেকে প্রায় ৩০০ বছর আগে বর্ধমানের নীলপুর গ্রাম থেকে ভাগ্যের খোঁজে বেরিয়ে বিষ্ণুপুরের মল্ল রাজাদের সান্নিধ্য লাভ করেন মুচিরাম ঘোষ| মল্ল রাজাদের দাক্ষিন্যেই দামোদরের উপনদী বোদাই এর তীরে বিশাল এলাকার জমিদারী লাভ করেন তিনি| পরবর্তীকালে একাধিক নীলকুঠি পরিচালনা করে বিশাল সম্পত্তি লাভ করে ওই জমিদাররা| এর পরই বাঁকুড়ার হদল নারায়ণপুর গ্রামের মাঝে বিশাল জমিদারবাড়ি তৈরি করে শুরু হয় দুর্গা পুজো| ৩০০ বছর পেরিয়ে আজও সেই পুজোকে ঘিরে এলাকার মানুষের উন্মাদনায় এতটুকুও ভাঁটা পড়েনি| ৩০০ বছর আগে নীলপুর গ্রাম থেকে বেরিয়ে বাঁকুড়ার রামপুর গ্রামের বিখ্যাত আর্যা শুভঙ্করের সঙ্গে বন্বুত্ব হয় মুচিরাম ঘোষের| বিখ্যাত গণিতজ্ঞ হওয়ায় বিষ্ণুপুরের মল্ল রাজ দরবারে শুভঙ্করের আলাদা খাতির ছিল| এই শুভঙ্করের সূত্রেই মল্ল রাজাদের কাছ থেকে নির্দিষ্ট বার্ষিক খাজনার বিনিময়ে দামোদরের উপনদী বোদাই এর কাছে উর্বর বিশাল এলাকার জমিদারী সত্ব লাভ করেন মুচিরাম ঘোষ| বেশ কয়েকটি তালুক নিয়ে বিশাল এলাকার জমিদার হওয়ায় মল্ল রাজারা তাঁদের মণ্ডল উপাধি দেয়| জমিদারি পতনের সাথে সাথেই হদল নারায়ন পুর গ্রামের মাঝে গড়ে ওঠা বিশাল জমিদারবাড়ির মন্দিরে শুরু হয় দুর্গা পুজো| পরবর্তীকালে ওই উর্বর এলাকায় ব্রিটিশরা নীল চাষ শুরু করলে ব্রিটিশ শক্তির সাথেও বন্বুত্বের সম্পর্ক গড়ে ওঠে এই মণ্ডল জমিদারদের| আরও পরে ব্রিটিশদের কাছ থেকে ওই এলাকার মোট ৭ টি নীলকুঠী ইজারা নিয়ে নেয় মণ্ডলরা| কথিত আছে সে সময় বোদাই নদীতে নীল বোঝাই করা বজরা ভাসিয়ে দূর দুরান্তে তা রপ্তানি করত মণ্ডলরা| সে সময় নীল বিক্রি করে প্রচুর ধন সম্পদ নিয়ে বজরায় করে গ্রামে ফেরার সময় কোন এক জায়গায় জল দসু্যদের কবলে পড়েছিল মণ্ডল বাড়ির কোন এক পূর্বপুরুষ| জল দসু্যর হাত থেকে বেঁচে ফিরলে বজরায় থাকা যাবতীয় সম্পত্তি দুর্গার নামে দেবত্র করে দেওয়ার মানত করেন তিনি| পরে তিনি সুস্থ ভাবে ফিরে এলে ওই বজরায় থাকা সমস্ত ধন সম্পদ দিয়ে বিশাল দুর্গা দালান, রাস মঞ্চ, রথ মন্দির, নাট মন্দির, নহবত খানা তৈরি করেন| বংশ পরম্পরায় পুজো চালিয়ে যাওয়ার জন্য বহু জমি ও পুকুর কিনে সেগুলি দুর্গা র নামে দেবত্র করে দেন| এক দিকে নীল কুঠির বিপুল আয় অন্যদিকে বিশাল জমিদারির খাজনায় ফুলে ফেপে ওঠে রাজকোষ| তার প্রভাব পড়ে দুর্গা পুজোতেও| সে সময় পুজার সময় সাত দিন ধরে নহবত খানায় বসত নহবত| দুর্গা মন্দির সহ সমস্ত মন্দির সাজানো হত বেলজিয়াম গ্লাসের বিশাল ঝাড় বাতিতে| বসত পুতুল নাচের আসর, হত যাত্রাপালা| দুর্গা পুজার প্রতিটি নির্ঘণ্ট ঘোষিত হত তোপ ধ্বনির দ্বারা| দূর দূরান্তের মানুষ ও প্রজারা হাজির হতেন জমিদারবাড়িতে| আজ আর সেই নীল কুঠিও নেই, নেই জমিদারিও| তৱু বিশাল দেবত্র এস্টেট এর আয়ে দুর্গা পুজায় আয়োজনের ত্রুটি রাখেন না মণ্ডল বাড়ির বর্তমান প্রজন্ম| আজো পুজো এলেই মন্ডল জমিদারবাড়ির নহবত খানা থেকে বেজে ওঠে সানাই এর সুর| দেশ বিদেশে ছড়িয়ে থাকা পরিবারের সদস্য রা আজো পুজার সময় ছুটে আসে|
