পশ্চিমবঙ্গের মুর্শিদাবাদ জেলার ধুলিয়ানের জাফরাবাদে গ্রামের শেষ প্রান্তে গঙ্গা নদীর তীরে অবস্থিত একটি এলাকা এখন নীরবতা ও শোকে নিমজ্জিত। এখানকার প্রতিটি বাড়িতে, যেখানে একসময় হাসি-খুশির বাতাবরণ ছিল, এখন ভাঙা দরজা, ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা জিনিসপত্র এবং ইটের টুকরো, সেই ভয়াবহ বিকেলের পরিস্থিতি জানান দিচ্ছে, যখন হাজার হাজার হিংস্র মানুষ এই বাড়িটিকে মৃত্যুক্ষেত্রে পরিণত করেছিল। গত শনিবার, ১২ এপ্রিল হরগোবিন্দ দাস ও তার ছেলে চন্দন দাসকে তাদের বাড়ি থেকে টেনে বের করে ধারালো অস্ত্র দিয়ে আক্রমণ করে হত্যা করা হয়। একই দিনে, একটি বাড়ি থেকে দু’টি মৃতদেহ বের করা হয়েছিল এবং চিৎকার, কান্না ও প্রশ্ন রেখে গিয়েছিল। “টাকা কি আমার ছেলে এবং স্বামীকে ফিরিয়ে আনবে?” ঘরের ভেতরে, এক কোণে বসে এই কথা বলছেন ৬৫ বছর বয়সী পারুল দাস – চন্দনের মা এবং হরগোবিন্দের স্ত্রী। তাঁর চোখের জল শুকিয়ে গেছে। ভাঙা গলায় সে বলে, “আমি মমতা দিদির বাংলার একজন মা… টাকা দিয়ে আমি কী করব… টাকা কি আমার স্বামী আর ছেলেকে ফিরিয়ে আনতে পারবে?” সে আর্থিক সাহায্য গ্রহণ করতে অস্বীকার করে। তার কথাগুলো স্পষ্টভাবে সেই অশ্রুসিক্ত বেদনাকে প্রতিফলিত করে যা কেবল একজন মা এবং স্ত্রীই অনুভব করতে পারেন।
ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শীরা বলছেন, আক্রমণটি সুপরিকল্পিত ছিল। প্রথমে পাথর ছোঁড়া, তারপর দরজা ভেঙে ভেতরে প্রবেশ করা এবং তারপর লাঠি, তরবারি এবং লোহার রড দিয়ে আক্রমণ করা। স্থানীয়রা বলছেন, “হাত কেটে ফেলা হয়েছিল, পা কেটে ফেলা হয়েছিল এবং সারা শরীরে ক্ষত ছিল।” হরগোবিন্দ দাসের মেয়ে কাঁদতে কাঁদতে বলছে, বাড়ি লুটপাট করা হয়েছে এবং জিনিসপত্র ধ্বংস করা হয়েছে। সেই বর্বরতার মাঝে, কেবল একটি প্রশ্নই ভেসে উঠল – “এই দেশে হিন্দু হওয়া কি অপরাধ?”
ছেলের চোখে শুধু অশ্রু নয়, আগুনও। মাত্র ১১ বছর বয়সী চন্দন দাসের ছেলে আকাশ, তাঁর বাবা এবং দাদুর ষষ্ঠীর দিনে (বৃহস্পতিবার, যখন হিন্দুস্থান সমাচারের দল গ্রাউন্ড রিপোর্টিংয়ের জন্য তাঁর বাড়িতে পৌঁছেছিল) ভগ্ন হৃদয়ে বলে, “বাবা এবং দাদুর কী দোষ ছিল? তাদের যেভাবে হত্যা করা হয়েছে সেভাবে তাদের শাস্তি দেওয়া উচিত। আমি এখনও পড়াশোনা করছি, সময় এলে আমি তোমাদের বলব আমি কী হব।” তার প্রশ্নের কোনও জবাব হয় না, প্রশাসনের কাছেও নয়, রাজনীতির কাছেও নয়।
“কেন আমাদের মারা হল… শুধুমাত্র হিন্দু বলে?” চন্দনের শ্যালিকা শ্রাবণী দাস রাগে তখন কাঁপছেন। তিনি বলেন, “আমাদের কারও সঙ্গে কোনও শত্রুতা ছিল না। তাহলে আমাদের বাড়িতে কেন হামলা করা হয়েছিল? কেন আমাদের মারা হয়েছে? শুধুমাত্র হিন্দু বলে?” তার কণ্ঠে এখন কোনও ভয় নেই, বরং বেদনা।
অনেক সংবাদ মাধ্যম কর্মী মিথ্যা খবর প্রচার করছেন বলেও তাঁদের অভিযোগ। চন্দন এবং হরগোবিন্দের পরিবারের ক্ষোভ কেবল সরকার এবং আক্রমণকারীদের উপর নয়, বরং সংবাদ মাধ্যমের একটি বড় অংশের উপরও। জাতীয় গণমাধ্যমের অনেক সাংবাদিক এখানে এসেছিলেন, তাঁদের বক্তব্য শুনেছিলেন এবং গিয়ে খবর প্রকাশ করেছিলেন যে, বাবা ও ছেলের মধ্যে শত্রুতা ছিল, যে কারণে এই হত্যাকাণ্ড ঘটেছে। হাজার হাজার দাঙ্গাবাজের বর্বরতার শিকার একটি পরিবার, মিডিয়ার এই মনোভাব দেখে কেবল মর্মাহতই নয়, বিস্মিতও। তাঁরা বুঝতে পারছে না কাকে বিশ্বাস করবে। সরকার নীরব, গ্রাম ভীত। ঘটনার পর এলাকায় বিশাল পুলিশ বাহিনী মোতায়েন করা হলেও, স্থানীয় মানুষের মধ্যে আতঙ্ক বিরাজ করছে। অনেকেই গ্রাম ছেড়ে নিজেদের আত্মীয়স্বজনের বাড়িতে চলে গিয়েছেন। সরকার অবশ্যই ক্ষতিপূরণ ঘোষণা করেছে, কিন্তু ক্ষতিগ্রস্ত পরিবার তা গ্রহণ করতে স্পষ্টভাবে অস্বীকার করেছে। এখন তাদের কাছে টাকা অথবা নিরাপত্তা কোনটাই গুরুত্বপূর্ণ নয়, কারণ তাদের কাছ থেকে সবকিছু কেড়ে নেওয়া হয়েছে।