কলকাতা : এক অর্থে ধবধবে সাদা ধুতিপাঞ্জাবি পরিহিত বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য বাংলার রাজনৈতিক ইতিহাসে নিজের যে ব্যক্তিত্বটি উপহার দিয়ে গেলেন, তা একান্তই একবর্ণী নয়। কেবলই শ্বেত-শাসিত একঘেঁয়েও নয়। বরং বর্ণময়ই বলা যায় তাকে। কেননা, বারবার বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যকে ঘিরে দেখা দিয়েছে বিতর্কের ঘূর্ণাবর্ত। সম্ভবত দিনে-দিনে দলীয় অনুশাসনকে মান্যতা দিয়েও নিজস্ব একটি ঘরানা ও মেজাজ রচনায় বিশিষ্ট ও সফল হয়েছেন তিনি। আজ প্রয়াণকালে একবার ফিরে দেখা যাক ‘বিতর্কিত’ বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যকে। কেননা, সেইসব বিতর্কের অভিমুখ তাঁকে যতটা না ম্লান করে, ততোধিক অন্যরকম এক আলো এসে পড়ে তাঁর শ্বেতশুভ্র পাঞ্জাবির ভাঁজে-ভাঁজে। ভুল-ঠিকের ঊর্ধ্বে সে-আলো জীবনের। সে-আলো জঙ্গমের। সেই আলো সমালোচনার ছায়াকেও জায়গা ছেড়ে দেয় বই-কি!
সালটা ১৯৯৩। রাজ্যে অপ্রতিরোধ্য বাম-জমানা। মুখ্যমন্ত্রী প্রবল প্রতাপান্বিত জ্যোতি বসু। তথ্যসংস্কৃতি সহ পুর ও নগরোন্নয়ন দফতরের মন্ত্রীত্ব ছেড়ে দিলেন বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য। শোনা যায়, সেই সময় বাম সরকারের একাধিক মন্ত্রীর জীবনযাত্রা ও নৈতিকতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিলেন বীতশ্রদ্ধ বুদ্ধদেব। তিনি নাকি বিরক্তি গোপন না করে বলেছিলেন, ‘চোরেদের মন্ত্রিসভায় থাকতে চাই না।’ এ’নিয়ে সে-ই নয়ের দশক থেকে যে জলঘোলা শুরু হয়েছিল, তা তাঁর মৃত্যুর পরেও অমীমাংসিত থেকে গেল। কারণ, এই মন্তব্য প্রসঙ্গে পরবর্তী কালে কখনও মুখ খোলেননি স্বয়ং বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য। তাঁর সিপিআইএম দল এযাবৎ দাবি করে এসেছে, বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য এমন উক্তি কখনও করেননি। যদিও বারবার বাম-বিরোধী দলগুলি, বিশেষত তৃণমূল কংগ্রেস, বহুবার মন্তব্যটিকে হাতিয়ার করেছে। তৃণমূলের সর্বোচ্চ নেতৃত্বও এই নিয়ে মুখর হয়েছে। তাতে অবশ্য বিতণ্ডা বেড়েছে বই কমেনি। এমনকি, সিপিআইএম দল ও বাম-রাজনীতির অভ্যন্তরেও এই নিয়ে অব্যাহত থেকেছে দ্বিধাগ্রস্ত ধারণা।
সময় গড়ালে, নতুন সহস্রাব্দে, দলের পলিটব্যুরো সদস্য, স্বচ্ছ ও গ্রহণযোগ্য ব্যক্তিত্বের বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যকে রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীর আসনে বসিয়ে বাম-জমানাকে দীর্ঘতর করতে সমর্থ হয় সিপিআইএম। প্রথম ৫ বছরের মেয়াদ সফল ভাবে উতরেও দেন বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য। রাজ্যবাসীর চোখে ‘উন্নততর বামফ্রন্ট’-এর মায়াঞ্জন সেই সময়সীমায় একটুও ম্লান হয়নি তাঁর প্রশাসনিক নেতৃত্বে। ২০০৬-এর বিধানসভা নির্বাচনের ফলাফলেই তা স্পষ্ট। কার্যত উড়ে যান বিরোধীরা। ২৩৫ আসনে জয়ের জনাদেশ পেয়ে ফের মুখ্যমন্ত্রীত্বে আসীন হন বুদ্ধবাবু। কিন্তু এরপরই শুরু হয় ‘আমরা-ওরা’ বিতর্ক। এবং প্রায় একই সঙ্গে এসে পড়ে হুগলির সিঙ্গুরে ন্যানো কারখানা নির্মাণের ইস্যু। টাটাকে জমি দিতে বদ্ধপরিকর বাম সরকার মূলত বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের একরোখা ও মরিয়া প্রবণতার উপরই আস্থা রাখে। বাম শরিকদের একাংশ যদিও তাঁর জমিনীতি প্রসঙ্গে দ্বিমত প্রকাশ করেছিল, তবে তা গ্রাহ্য করেননি তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য ও তাঁর অনুগামীরা। ফলাফল হয়েছিল বিষবৎ। কালক্রমে সিঙ্গুরের সঙ্গে জুড়ে যায় নন্দীগ্রামও। সেখানে পুলিশের গুলিচালনায় মৃত্যু প্রসঙ্গে চূড়ান্ত অসংবেদনশীল মন্তব্যটি করে বসেন তদানীন্তন মুখ্যমন্ত্রী স্বয়ং। ‘দে হ্যাভ বিন পেড ব্যাক ইন দেয়ার ওন কয়েন,’ বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের এমন শ্লেষ ঘিরে ঝড় ওঠে বাংলা জুড়ে। তবু নিজ-মন্তব্যে অটল থাকেন বুদ্ধবাবু!
সিঙ্গুর-নন্দীগ্রামের জনরোষ পরিণামে ডেকে এনেছিল অবধারিত অথচ অবিশ্বাস্য পতন। ২০১১-র বিধানসভা নির্বাচনে ছেদ পড়েছিল দীর্ঘ বাম-শাসনের। ফলত মুখ্যমন্ত্রী পদ খুইয়েছিলেন বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য। বাম-জমানার অবসান ও পরবর্তী কালে সিপিআইএম সহ বাম-দলগুলির জনসমর্থন শূন্যে নেমে যাওয়ার পিছনে আজও বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের ‘জেদ’কেই দায়ী করেন রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞদের একাংশ।
পরাজয় ও পতন। তার কিছুকাল পর থেকেই ফুসফুসে সংক্রমণজনিত টানা অসুস্থতা। গৃহবন্দি-শয্যাশায়ী দশা। তবু ফের তিনিই বিতর্কের কেন্দ্রে ফিরে এলেন ২০২২-এর গোড়ায়। বিজেপি শাসিত কেন্দ্রীয় সরকারের পদ্মভূষণ সম্মাননার প্রস্তাব ফিরিয়ে দিলেন বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য। সেই নিয়ে বুদ্ধদেবের ব্যক্তিগত মত ও দলের সিদ্ধান্তে কি কোনও টানাপোড়েন ছিল? উঠেছিল এমন প্রশ্নও।
আত্মীয়তা সূত্রে কবি সুকান্ত ভট্টাচার্যের সঙ্গে জড়িত বুদ্ধবাবুর প্রাসঙ্গিকতা বস্তুত তাঁর জীবৎকালে কখনও হারিয়ে যায়নি – না রাজনীতিতে সক্রিয় থাকাকালীন, না নিষ্ক্রিয় জীবনসায়াহ্নে। অন্যথায়, বাম-জমানার অবসানে আপন ভূমিকায় বিদ্ধ হয়েও তিনি একটা সময়ের বেস্ট সেলার গ্রন্থ ‘স্বর্গের নীচে মহাবিশৃঙ্খলা’ বা ‘নাৎসি জার্মানির জন্ম ও মৃত্যু’-র লেখক হিসেবে প্রতিভাত হতে পারতেন না। এখন তাঁর সমস্তটাই পড়ে রইল খোলা বইয়ের মতো পরম ঔদার্যে। মহাকালের পাঠ বোধকরি অনিঃশেষ। রচয়িতা চলে গেলেন অনন্তযাত্রায়।