কলকাতা : একটি সিকিউরিটি রুম| অথবা একটি লাইব্রেরি| মানে, এটা ঠিকই যে, এক নিরাপত্তা রক্ষীই ঘরটিতে মগ্ন থাকেন তাঁর আপন কর্তব্যে| তবে কেবল তিনিই যে থাকেন, এমন নয়| থাকেন কাব্য-সাহিত্য-শিল্প-দর্শন-বিজ্ঞান-হিসাবশাস্ত্র-রাজনীতি, মায় ক্রীড়া জগতের রথী-মহারথীরাও| কীভাবে এলেন তাঁরা এঘরে, সেকথায় পরে আসছি| আগে বলে নেওয়া জরুরি, এঘরে কীভাবে থাকেন তাঁরা| থাকেন পুরোনো মলাটের বন্ধনে – র্যাকে র্যাকে, থাকে থাকে|
সত্যরঞ্জন দলুই| দক্ষিণ ২৪ পরগনার পাথরপ্রতিমা থেকে এসে এখন উত্তর কলকাতার শ্যামবাজারেরই বাসিন্দা বলা যায়| সেই ২০১০ থেকে সত্যরঞ্জনের জগৎ বলতে জগৎ মুখার্জি পার্ক| নয়-নয় করে ১৪ বছর তো আর কম দিন নয়! পার্কের সিকিউরিটি গার্ড হিসেবে জুলপি পাকার উপক্রম হল সত্যরঞ্জনের| তা হোক| তবু প্রেমে এখনও কোনও ঘাটতি নেই| ভাটির টান নেই মগজে-হৃদয়ে| বইয়ের প্রেমে এখনও পাগল সত্যরঞ্জন| পাগল সুরের প্রণয়েও| সবুজেরও প্রীতিতে|
সিকিউরিটি রুমে কাঁহাতক আর চুপচাপ বসে থাকা যায়? সকল সময় তো আর চাপ থাকে না নিরাপত্তার কাজকম্মে! ফলে একঘেঁয়ে কালস্রোত মিছেই বয়ে যায় দিনের পর দিন – উদ্দেশ্যহীন| চাকরির শুরুর দিকে সত্যরঞ্জন দলুইয়ের কাছে এ এক বিষম সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছিল নির্ঘাত| দু-একটা বই, কয়েকটা পত্রিকা তাই হাতের কাছে প্রথম-প্রথম রাখতেন তিনি| কাজ হাল্কা হয়ে এলে, বেশ লাগত পড়তে! পরে সেটাই নেশা হয়ে দাঁড়াল| সন্ধান পেলে নিজেই ছুটতেন কাছেপিঠের দোকান থেকে পছন্দের বই কিনে আনতে| তবে অনেকবার এমনও হয়েছে, কেবল অর্থের কারণে হাতছাড়া হয়ে গিয়েছে ভালো লাগা বই| তেমন আর্থিক সচ্ছলতা তো ছিল না গোড়ার দিকে! তবে তাতেও দমে যাননি সত্যরঞ্জন| খোঁজখবর রাখতেন আশপাশের বাড়ির| কেউ পড়া হয়ে যাওয়া বইপত্র বাতিল করতে চাইলেই, পৌঁছে যেতেন ঝোলা হাতে| আর এভাবেই সত্যরঞ্জন দলুইয়ের ঘর, অর্থাৎ কিনা শ্যামবাজারের জগৎ মুখার্জি পার্কের সিকিউরিটি রুম আজ হয়ে উঠেছে রীতিমতো গ্রন্থাগার| কত যে মূল্যবান গ্রন্থ রয়েছে সত্যরঞ্জনের সংগ্রহে, সত্য কথা বলতে কী, তার ইয়ত্তা নেই! ১২ হাজার তো কবেই ছাড়িয়েছে বইয়ের সংখ্যা!
সকাল-বিকেল জগৎ মুখার্জি পার্কে বেড়াতে আসেন বিভিন্ন বয়সের মানুষ| বয়স্ক, মাঝবয়সী, তরুণ-তরুণী থেকে কচিকাঁচা সকলেই পার্কে ঢুঁ মেরে ঢুকে পড়েন সত্যরঞ্জনের বই-ডেরায়| এমনকি, অফিস ফেরতা কেউ কেউ কেবল গ্রন্থপাঠের উদ্দেশ্যেই হাজির হন নিয়মিত| তাঁদের মূল্যবান অভিজ্ঞতায় ধরা পড়ে সত্যরঞ্জন দলুইয়ের অমূল্য উদ্যোগের অপরিসীম গুরুত্ব|
সত্যরঞ্জনের আগ্রহ অবশ্য বইপত্রেই সীমাবদ্ধ নয়| শুরুর দিকে সে ব্যাপারে খানিক আভাস দিয়েছি, খেয়াল করেছেন নিশ্চই| এবার বিশদে বলি| জগৎ মুখার্জি পার্কে বিচিত্র গাছগাছালির বিপুল সম্ভারের পিছনেও কাজ করেছে সত্যরঞ্জন দলুইয়ের সত্যনিষ্ঠ হাত| সত্যটা এই যে, সবুজ না থাকলে অবুঝ মানুষ ডেকে আনবে নিজেরই অস্তিত্বসঙ্কট| অতএব বলতেই হচ্ছে, সত্যরঞ্জন দলুই গ্রন্থমনস্ক নন শুধু| তিনি পরিবেশ-সচেতনও বটে| আর সমাজ-সচেতনতা? ব্যতিক্রমী এই নিরাপত্তা কর্মী তাতেও কিছু কম যান না। পথশিশুদের পড়াশোনা ও সুকুমার বৃত্তিগুলির চর্চার ব্যবস্থা করেছেন তিনি ওই শ্যামল বৃত্তের সতেজ পরিসরে|
একটা সযত্নরক্ষিত হারমোনিয়াম প্রমাণ করছে, সত্যরঞ্জন দলুই নিশ্চয়ই সঙ্গীতরসিক| লাইব্রেরি কাম সিকিউরিটি রুমে রয়েছে প্রাথমিক চিকিৎসা ও টুকটাক স্বাস্থ্য পরীক্ষার ব্যবস্থাও| সব মিলিয়ে, বহুমুখী সচেতনতা ও বিচিত্রগামী শুভ প্রবণতার সম্মিলনে পাথরপ্রতিমার সত্যরঞ্জন আজ হয়ে উঠেছেন জগৎ মুখার্জি পার্কের অনন্য সত্যরঞ্জন| একথার মধ্যে কেবল সত্যরঞ্জনই আছে, কোনও অতিরঞ্জন নেই|