৪ আশ্বিন ১৪৩২ রবিবার ২১ সেপ্টেম্বর ২০২৫
৪ আশ্বিন ১৪৩২ রবিবার ২১ সেপ্টেম্বর ২০২৫

কোচবিহার মদনমোহন বাড়ীর ব্যাতিক্রমী মনসা পুজো

High News Digital Desk:

কোচবিহার মদনমোহন বাড়ীর ব্যাতিক্রমী মনসা পুজো :

কোচবিহার,১৮ আগস্ট: কোচবিহার মদনমোহন বাড়ির নানান পুজোর মধ্যে মনসা পুজো বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। কারণ তার ব্যতিক্রমী রূপ ও পূজা পদ্ধতি। বাংলায় হিন্দু দেবদেবীদের মধ্যে কুলীনতার দিক থেকে একটু পিছিয়ে আছেন মা মনসা। কিন্তু গ্রাম বাংলায় প্রায় প্রতিটি ঘরেই বিশেষত রাজবংশী সমাজে তাঁকে ছাড়া আজও অনেক শুভ কাজই সম্পন্ন হয় না। শ্রাবণ মাসের শেষদিন ও ভাদ্র মাসের শুরুর দুদিন কোচবিহার মদনমোহন বাড়ির কাঠামিয়া মন্দিরে চলছে মনসা পুজো। পুরনো ট্রাডিশনকে বজায় রেখে আজও এখানে তিন দিন ধরে চলে মা মনসার পুজো। আর অবশ্যই সঙ্গে থাকে বিষহরি পালা।

সাধারণত মনসা প্রতিমা আমরা যেমনটা দেখে থাকি এখানে ঠিক তেমনভাবে প্রতিমা নির্মাণ হয় না। প্রথম থেকেই ব্যতিক্রমী প্রতিমা হয়ে আসছে বলে জানা গেল দেবোত্তর ট্রাস্টবোর্ডের তরফে। এখানে মাটির প্রতিমার বদলে শোলা দিয়ে তৈরি করা হয় মনসা, যাকে স্থানীয় ভাষায় বলা হয় মন্ডুষ। বংশ পরম্পরায় প্রতিমা নির্মাণের দায়িত্ব পেয়ে আসছেন ভেটাগুড়ির ধীরেন্দ্র মালাকার। তার বাবা নরেন্দ্রনাথ মালাকারের কাছে এই প্রতিমা নির্মাণের কাজ শিখেছিলেন তিনি। প্রতিমার রূপ হিসাবে যে চারটি সোলার খাঁচা তৈরি হয় তাদের মন্ডুষ বলে। জানা গেল, মহারাজারা চার শরিক ছিলেন জন্য বিভিন্ন আকারের চারটি মন্ডুস বানানো হত। আজও সেই প্রথা বহাল আছে। প্রতিটি মন্ডুষের মাথার উপরে থাকে একটি করে সাপের ফনা। সোলার পাতলা পাতের ওপর এরপর থাকে নানা চিত্র। যার শুরুতেই রয়েছেন স্বয়ং শ্রীকৃষ্ণ। এই চিত্রগুলোতে মনসার কাহিনী বর্ণনা করা হয়। লক্ষ্য করলে দেখা যায় এখানে দেবদেবীর চিত্র যেমন রয়েছে, তেমনি রয়েছে চাঁদ সওদাগরের সপ্ত ডিনার চিত্র। এছাড়া শিব, পার্বতী, কার্তিক, গণেশ, বেহুলা, লক্ষীন্দর সহ অনেকেরই চিত্র এখানে আঁকা থাকে। একদম নিচে থাকেন একটু মোটা সোলা দিয়ে তৈরি অষ্ট নাগ সহ মা মনসা। প্রতিটি মন্ডুষের একদম নিচে থাকেন মা মনসার ছোট সোলার মূর্তি। তার পাশে থাকে মনসামঙ্গলের বিভিন্ন চরিত্র – গোদা, নেতা, সেপাই, পুরোহিতের ছোট ছোট শোলার মূর্তি। মাঝের সবচাইতে বড় মন্ডুষের উচ্চতা সাড়ে সাত হাত। বাম দিকেরটা সাড়ে চার হাত। ডানদিকের পরপর দুটো সাড়ে তিন হাত তো আড়াই হাতের হয়। মনসার ঘট স্থাপনের মধ্য দিয়ে শুরু হয় পুজো। পরে মন্ডুষের সামনে ওই ঘট বসিয়ে বাকি দিনগুলো পুজো হয়। পুজোয় পায়রা বলি দেওয়ার নিয়ম যেমন রয়েছে, তেমনি এই পুজোয় আটটি হাঁসের ডিমও সমান জরুরী।

তিনদিনের এই পুজোর শেষ দিনে করতে হয় চাঁদ সওদাগরের পুজো। মনসামঙ্গলের কাহিনী শেষে আমরা দেখি চাঁদ সওদাগর ‘চ্যাং মুড়ি কানি ‘ অর্থাৎ মা মনসাকে অবশেষে পূজা করছেন কিন্তু বাঁ হাত দিয়ে। এখানেও আমরা এই প্রাচীন রীতি দেখতে পাই। পুজোর তৃতীয় দিনে প্রধান পুরোহিত যজ্ঞ করে পুজোর শেষ করলে এই চাঁদ সওদাগরের পুজো না হলে অসমাপ্ত থেকে যায় মদন মোহন বাড়ির মনসা পূজো। তাই প্রথম থেকে এই পুজোয় বংশ পরম্পরায় চাঁদ সদাগরের ভূমিকা পালন করে আসছেন মাথাভাঙ্গার অমর কুমার গোপ (ঘোষ)। তিনি পূজোর শেষ দিন রাতের বেলা মনসাকে বাঁ হাতে পূজা করেন। শেষ হয় মনসা পূজো। ঘট চলে যায় কাঠামিয়া মন্দির থেকে নিজের জায়গায়। একে বলে ‘ঘট ঘর করা’।

বংশপরম্পরায় যারা মদনমোহন বাড়ির মনসা প্রতিমা তৈরি করে আসছেন বর্তমানে সেই কাজ করা এক প্রকার অসম্ভব হয়ে পড়ছে বলে জানালেন ধীরেন্দ্র মালাকার। ভেটাগুড়ির বাসিন্দা ধীরেন্দ্র বাবুর পেশাই হল শোলার কাজ। অথচ এই মন্ডুষ তৈরি করতে যে ধরনের সোলার প্রয়োজন তা এদিকে পাওয়া যাচ্ছে না। মাঝে আসাম থেকে এই শোলা তারা কিনে নিয়ে আসতেন। বর্তমানে তা কিনতে হচ্ছে কলকাতা থেকে। কোচবিহারে এই শোলার দাম এতই বেশি এবং উৎপাদন কম সেজন্য শোলার কাজ করতে তাদের যথেষ্ট বেগ পেতে হচ্ছে । বর্তমান বাজারদর ও তাদের নিজস্ব খাটুনি মিলিয়ে সামান্য টাকায় কিছুই হয় না বলে জানান তিনি। স্ত্রী ঊষারণী সোলার উপর চিত্র অঙ্কন করে স্বামীকে সাহায্য করেন। আগে দুই ছেলের কারোরই এটার উপর খুব একটা ঝোঁক ছিল না। বর্তমানে তারাও এই কাজে হাত লাগিয়েছে। ধীরেন্দ্রবাবু জানান, আমার কাছে মদনমোহন বাড়ির মনসা প্রতিমা গড়ার এই কাজ যথেষ্ট সম্মানের। ওখান থেকে পাওয়া সামান্য টাকায় কিছু হয় না তবুও যতদিন বাঁচবো ঠাকুরের সেবায় এই মূর্তি গড়ে যাব।

রাজ আমল থেকে হয়ে আসা এই পুজোর সময় তিনদিন ধরে চলতো মনসা পালা বা বিষহরি পালা গান। এখনো সেই প্রথা অটুট। মনসা পুজো উপলক্ষে তাই আজও শহরের বুকে শোনা যায় বিষহরি পালা। গ্রামীণ সংস্কৃতি থেকে এক প্রকার হারিয়ে যেতে বসেছে এইসব বিষহরি সাইটোল গানগুলো। কিন্তু পুজোর তিনদিন প্রতিবছর মদনমোহন বাড়িতে কাঠামিয়া মন্দিরের সামনে ম্যারাপ বেঁধে এই বিষহরি পালা অনুষ্ঠিত হয় সন্ধ্যাবেলায়। মনসা মঙ্গল পদ্মপুরাণ এইসব মঙ্গলকাব্য থেকে কিছু কিছু অংশ বাছাই করে এই পালা তৈরি করেন মালাকারেরা। এবারেও তার অন্যথা হয়নি।

Scroll to Top