পূর্ব বর্ধমান : নয়-নয় করে ১৪টা বছর! নিখোঁজ ছেলের পথ চেয়ে বসে আছেন মা। এই বুঝি বাড়ি ফিরল ‘হারানো মানিক’। কিন্তু সে-আশা তাঁর এখনও পূরণ হয়নি। তবু অপেক্ষা আছে। আর আছে অসহায় অশ্রু। তা বুঝি শুকোনোর নয়! নিরন্তর এত জলও থাকে ওই দুটি চোখে!
কিন্তু কার জন্য অশ্রুপাত? কার জন্য অনন্ত অপেক্ষা-এই? খুলে বলা যাক তবে।
পূর্ব বর্ধমানের মেমারি থানার নিমো ১ নম্বর গ্রাম পঞ্চায়েতের তেলসরা গ্রাম। এ গ্রামেরই এক বাড়ির ঠিকানায় আজও এসে পৌঁছয় কনস্টেবল সাবির মোল্লার বেতন। যদিও বহুবছর হল, সাবির বেহদিশ! মা জাহানারা বেগম বা দাদা সামাদ মোল্লা – কেউই জানেন না, সাবির আজ কোথায়!
২০০৯ সালের ৩০ জুলাই – তারিখটা কোনও দিন ভুলতে পারবে না তেলসরা গ্রামের মোল্লা-বাড়ি। রাতে টিভিতে খবর চলছিল তখন। হঠাৎই বজ্রপাতের মত বেজে উঠল দুঃসংবাদ – তৎকালীন মাও-প্রভাবিত লালগড়ের ধরমপুরে পোস্টিং হওয়া পুলিশকর্মী সাবির মোল্লা সহ নিখোঁজ ২!
সাবিরের সঙ্গেই ছিলেন তাঁর সহকর্মী কাঞ্চন গরাই। বেপাত্তা ২ পুলিশকর্মীর দ্বিতীয় জন তিনি। দু’জনের কেউই বাড়ি ফিরে আসেননি আজও।
রাজনৈতিক অস্থিরতায় সে-সময়কার টালমাটাল জঙ্গলমহল সেই ঘটনার পর রহস্যজনকভাবে থমথমে রূপ নেয়। হন্যে হয়ে ফোন নাম্বার জোগাড় করে, মাওবাদী নেতা কিষেণজি, ছত্রধর মাহাতো, অর্ণব দামের সঙ্গে যোগাযোগ করেও কোনও খবর মেলেনি। জানাচ্ছেন নিখোঁজ সাবির মোল্লার দাদা।
তদানীন্তন রেলমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সাবিরের দাদা-বৌদিকে নিয়ে গিয়েছিলেন দিল্লি। দেখা করিয়েছিলেন সে-সময়কার কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী পি চিদম্বরমের সঙ্গে। তাতে আজও কৃতজ্ঞ জাহানারা বেগম, সামাদ মোল্লারা।
কিন্তু কাজের কাজ হল কই? ২০০৯ থেকে ২০২৪! আজও সম্পূর্ণ অন্ধকারে সাবিরের পরিবার। মা অপেক্ষায়। বাস্তববাদী দাদা চাইছেন, এবার সরকার কিছু ঘোষণা করুক। নিখোঁজ ব্যক্তির সামান্য বেতন পেয়ে কী হবে? অন্তহীন অপেক্ষার শেষে আলো কোথায়? এর চেয়ে ‘মৃত’ ঘোষণাও যে শ্রেয়! এবং সম্ভবত সত্যের সবচেয়ে কাছাকাছি। মনে করছেন সাবিরের আত্মীয়রা। সেদিনের মাওবাদী নেতা অর্ণব দাম আজ প্রশাসনিক সহায়তায় পিএইচডি করার অধিকার পাচ্ছেন। ভালো কথা। ‘মাও-অপহরণের শিকার’ সাবির মোল্লা কী পেলেন? তাঁর পরিবারই বা পেল কতটুকু? তিক্ত-অপ্রিয় প্রশ্নগুলো এবার জেগে উঠছে মোল্লাবাড়ির অন্দরে।
সময় কখনও-কখনও বড় জটিল। সময় কখনও-কখনও খুব নিষ্ঠুর। সময় কখনও-কখনও তার চেয়েও অসহনীয়। এখন সেই অসহনীয়তার ভিতর দিয়ে যাচ্ছেন সামাদরা। আর মা? জাহানারা বেগম? তিনি আজও কাঁদছেন। কেবলই কান্না দিয়ে তিনি হয়ত মুছে দিতে চাইছেন তাঁর হারানো সন্তানের ব্যথা। রক্তমোছা আঁচল মুঠিতে ভরে, হয়ত ঘোর লাগা এক স্বপ্নের ভিতর, তিনি ‘হারানো মানিক’কে বুকে চেপে ধরেছেন প্রগাঢ় মমতায়। জিজ্ঞাসা করছেন, ‘বাছা, ভালো আছিস তো?’