কলকাতা : উনবিংশ শতকে কলকাতায় হুজুগ উঠলেই রূপচাঁদ গান বাঁধতেন। রেল, বিধবা বিবাহ, কন্যাদায় – এইসব ছিল তাঁর বিষয়। ইতস্তত ইংরেজি শব্দ মেশানো সেই গান শহর জুড়ে তোলপাড় ফেলত। শিবনাথ শাস্ত্রীর ‘রামতনু লাহিড়ী ও তৎকালীন বঙ্গসমাজ’ গ্রন্থে পাওয়া যায়, ‘শহরের ভদ্র গৃহের নিষ্কর্মা সন্তানগণের অনেকে পক্ষীর দলের সভ্য হইয়াছিল। দলে ভর্তি হইবার সময় এক-একজন এক-একটি পক্ষীর নাম পাইত এবং গাঁজাতে উন্নতিলাভ সহকারে উচ্চতর পক্ষীর শ্রেণীতে উন্নীত হইত।’ এই রকমই একটি দল ছিল রূপচাঁদের।
রূপচাঁদ পক্ষী মনে করতেন তিনি নাকি উড়েও যেতে পারেন! তাই খাঁচায় করে আসতেন। গায়ে পাখির বেশভূষা। হাতে গাঁজার কল্কে। সেই রূপচাঁদের অবয়বকেই এবার মাটি, রঙ দিয়ে তুলে ধরা হল বরানগর বক্সীবাড়ির ঝুলন উৎসবে। তাঁর পক্ষীর বেশ, হাতে গাঁজার কল্কে, সঙ্গে বন্ধুদের টেনে নিয়ে আসা গরুর গাড়ির মতো একটি গাড়িতে খাঁচাটি। এমনই মডেল বরানগর বক্সীবাড়ির ঝুলনে এবারের অন্যতম আকর্ষণ।
বক্সীবাড়ির ঝুলনে এবারের ভাবনা ‘পুরনো কলকাতার ইতিকথা।’ গত কয়েক-শতকের পুরনো কলকাতার কিছু খণ্ডচিত্র তুলে ধরার চেষ্টা করা হয়েছে। রূপচাঁদ ছাড়াও রাখা হয়েছে ভিক্টোরিয়া, কালীঘাট মন্দির, চড়ক, কবিগানের লড়াই। এমনকী, পাথুরিয়াঘাটার মল্লিকদের শখের জেব্রাগাড়ির মডেলও দেখতে পাবেন বক্সীবাড়ির ঝুলন-উৎসবে।
হয়ত ভিস্তিওয়ালার মডেলের সামনে দাঁড়িয়ে আপনি ভেসে যাবেন প্রাচীন কলকাতার কোনও এক প্রেক্ষাপটে। গোধূলিতে শহরের মায়ামেদুর রাস্তা দিয়ে টুং টুং শব্দে যাত্রী নিয়ে টানা রিক্সার চলে যাওয়াও নষ্টালজিক করে তুলতে পারে আপনাকে। কিংবা, ওই দূরে, বটগাছের নিচে, কচিকাঁচাদের বায়োস্কোপ দেখার ভিড় আপনার ভালোলাগাকে বাড়িয়ে তুলবে অনেকটাই। আর বেহারাদের বয়ে নিয়ে যাওয়া সুন্দর পালকিটা দেখলে নিশ্চয়ই কানে এসে পৌঁছবে সেই ‘হুনহুনা হুনহুনা, পালকি চলে হুনহুনা’ কথাগুলো। পুরনো কলকাতার চাঁদপাল ঘাটে দাঁড়ালে যে’রকম পালতোলা জাহাজের সারি দেখা যেত এক-সময়, সেই পালতোলা জাহাজও তুলে ধরা হয়েছে। এসবের পাশে চড়কের দৃশ্যটা সত্যি চোখে পড়ার মতো। আর কবিগানের লড়াইয়ের আসরটা আপনাকে মনে পড়াবেই ভোলা ময়রা, অ্যান্টনি ফিরিঙ্গির কথা। আর রয়েছে রাধা-কৃষ্ণের ঝুলন যাত্রার একাধিক মডেল। সেটি অবশ্য আলাদা প্ল্যাটফর্মে করা।
পুরনো কলকাতার থিমের মডেলগুলো বানিয়েছেন কৃষ্ণনগরের বাবু দাস। জেব্রা গাড়ি, বায়োস্কোপটি শিল্পী আরতি পালের হাতে তৈরি। জমিদার বাড়ি ও কালীঘাট মন্দিরের মডেল গড়েছেন দেবশ্রী বক্সী। ভিক্টোরিয়া মডেল সুবীর দত্তের নির্মাণ। রূপচাঁদের খাঁচাটি বানিয়েছেন কুণাল গঙ্গোপাধ্যায়। শ্রীকৃষ্ণের বিভিন্ন লীলা, রাম-রাবণ সহ বেশ কয়েকটি মডেল আরতি পাল ও দক্ষিণদাড়ির শিল্পীরা গড়ে তুলেছেন। রূপসজ্জা দেবশ্রী বক্সী ও মৃণাল বক্সীর হাতে।
উদ্যোক্তাদের পক্ষ থেকে মৃণাল বক্সী জানিয়েছেন, ‘পুরনো কলকাতা নিয়ে মানুষের মনে একটা আলাদা আবেগ রয়েছে। আমরা সেই আবেগকেই ছুঁতে চেয়েছি। এই জন্যই কলকাতা ছাড়াও দূর থেকে মানুষ আমাদের এই ঝুলন দেখতে আসছেন। এটাই আমাদের প্রাপ্তি।’
১৫ আগস্ট থেকে শুরু হয়েছে বক্সীবাড়ির ঝুলন। দিনের হিসেবে উৎসব এখন সমাপ্ত হওয়ার পথে। আগামী সোমবার বক্সীবাড়ির ঝুলন উৎসবের শেষ দিন। বরানগর দর্জিপাড়ার কাছে, হরিসভার পাশেই বক্সীবাড়ি। সিঁথির মোড় থেকে অটোতে দর্জিপাড়ায় নেমে মিনিট পাঁচেকের হাঁটা পথ। চাইলে, পৌঁছে যেতেই পারেন বক্সীবাড়ি – পুরনো কলকাতার আবেশ মেখে ঝুলন উৎসবের সাক্ষী হতে।