বলিউড টলিউড জয় করেও শেকড়কে ভোলেনি মানিক :-
ইচ্ছে ছিল সেনাবাহিনীতে যোগ দেওয়ার। কিন্তু হয়ে গেল নৃত্য শিল্পী। যুদ্ধ গোলাগুলি বন্দুক চালানোর স্বপ্ন হারিয়ে সে পেলো একটা নতুন জগৎ, শিল্পের জগৎ, সৃষ্টির জগৎ। কোচবিহারের নৃত্যশিল্পী মানিক পালের জার্নিটা সত্যিই একটু অন্যরকম।
কোচবিহারের মামা বাড়িতে জন্ম। বাবা আসামে একটি চায়ের দোকান চালাত। ১৯৯৯ সালের এক জঙ্গি হামলায় মাত্র পাঁচ বছর বয়সে বাবাকে হারায় সে। দুই ছেলে এক মেয়েকে নিয়ে মা তখন অথৈ জলে। দাদা আসামেই একটা দোকানের কাজে ঢুকে গেল। মানিককে পাঠিয়ে দেওয়া হল মামার বাড়ি কোচবিহারে পিলখানায়। সেখানে ভর্তি হল রামকৃষ্ণ বয়েজ হাই স্কুলে। বাবার মৃত্যু সাংঘাতিক ভাবে নাড়িয়ে দিয়েছিল মানিককে। মনের মধ্যে তখনো ডিফেন্সে যাওয়ার ইচ্ছে প্রবল। আর তাই একদিকে সে ক্যারাটে শিখছে, দৌড়াচ্ছে, এনসিসিতে ভর্তি হয়েছে। ক্লাস নাইনে পড়ার সময় স্থানীয় রবীন্দ্রভবনে একটা ট্যালেন্ট হান্ট শোয়ের খবর পায়। কিছু না জেনেই চলে গেল মানিক এক বন্ধুর সাথে। সেটা ২০১০ সাল। অদ্ভুতভাবে অডিশনের সময় জিমন্যাস্টিক করতে পারা, ক্যারাটের জন্য টালি ভাঙতে পারা ছোট্ট মানিক, কিছু না বুঝেই সিলেক্ট হয়ে গেল সেই শোতে।
এরপর ডেসিনেশন কলকাতা। রূপসী বাংলার সেই শোয়ের নাম ছিল টক্কর। সেখানে অনামা মানিক মেন্টর হিসেবে পেল দিব্যেন্দু আার প্রসূন বলে দুই দাদাকে। এরপর গ্রুমিংয়ের পালা। ‘এরিয়াল অ্যাক্ট’ ব্যাপারটার সঙ্গে পরিচয় ও তাদের সূত্র ধরেই। আর এই এরিয়াল অ্যাক্টে ভীষণ ভালো পারফরমেন্স ছিল মানিকের। ফাইনালে ফাস্ট হলো সে। প্রাইজ মানি ২ লাখ টাকা। হঠাৎই যেন জীবনটা অন্য খাতে মোড় নিল। টলিউডের কোরিওগ্রাফার সুদর্শন চক্রবর্তী মানিকের প্রতিভায় মুগ্ধ হয়ে হাত বাড়িয়ে দিল তার দিকে। থাকা খাওয়ার কোন চিন্তা থাকল না। তার বাড়িতে থেকেই মানিক কে সে তৈরি করা শুরু করল শিল্পী হিসাবে। এদিকে সামনে মাধ্যমিক পরীক্ষা। পড়াশোনা করার সময় কোথায়! স্কুল করা তো হচ্ছেই না। সেই সময় শিক্ষকরা খুব সাহায্য করেছিলেন মানিককে। তারপর মাধ্যমিক পাস করলেও পড়াশোনাটা ঠিক হয়ে ওঠেনি। পুরোপুরি মন প্রাণ সঁপে দেয় নাচের দিকে। ফিরে যায় কলকাতায়। সেখানে নাচ শেখার পাশাপাশি চলতে থাকে কলকাতা, দিল্লি, মুম্বাই বিভিন্ন জায়গায় ডান্স গ্রপের সাথে শো করা। এবার বিদেশ যাত্রা। সুদর্শন চক্রবর্ত্তীর সাথে ইন্ডিয়ান এম্ব্যাসি থেকে ইন্দোনেশিয়া ট্যুরে গেল মানিক। দশটা জায়গায় ট্যুর করেছিল সেবার।
নাচ তো চলছে, কিন্তু সেখানে তো মানিক গ্রুপে দশজনের একজন। আলাদা কিছু করার ইচ্ছে তখন থেকেই মাথায় ঘুরছিল। হঠাৎই একটা লিফলেট দেখে ফোন করলো মুম্বাই শিবাজী পার্কের শ্রী সামর্থ ব্যায়াম মন্দিরে পদ্মশ্রী প্রাপক উদয় দেশপান্ডেকে। অদ্ভুতভাবে উনি বললেন, চলে এসো। হাতে যেন চাঁদ পেল মানিক। বিদেশ বিভূঁই, কিছুই জানা চেনা নেই, হিন্দিও তথৈবচ। হাতে সামান্য কিছু টাকা সম্বল করে পাড়ি দিল মুম্বাই। দেখা করলো উদয় দেশপান্ডের সাথে। সেখানে শেখাটা বিনা পয়সায় হত, কিন্তু থাকা খাওয়ার জোগারটা নিজেকে করে নিতে হবে। লোকাল ট্রেনে যেতে যেতে আবারও একটা বিজ্ঞাপনে চোখ আটকে গেল। সেখানে কাজের লোক চাওয়া হচ্ছে, অফিস বয়, ওয়েটার, হাউসকিপিং এসব বিভিন্ন পদে। হাউসকিপিং শব্দটার সাথে পরিচয় ছিল না মানিকের। ওই নাম্বারে ফোন করে কাজের কথা বলতেই তারা দেখা করতে বলল। তখনও জানা ছিল না, কি চমক অপেক্ষা করছে তার জন্য। হাউসকিপিং এর ড্রেস দিয়ে দেওয়ার পরে হাতে একটা ঝাঁটা দিয়ে দিল বাথরুম পরিষ্কার করার জন্য। তা সে যত বড় কোম্পানিরই হোক না কেন, বাথরুম তো! মানিকের ভাষায়, “চোখ ফেটে জল আসতো। কিন্তু আমি জানি আমাকে এখানেই পড়ে থাকতে হবে। বাথরুমের ডাস্টবিনগুলো যখন নিয়ে যেতাম তখন শুধু একটাই কথা বলতাম, আমাকে হারলে চলবে না। ৬/৭ মাস বিভিন্ন জায়গায় হাউসকিপিং এর কাজ করেছি। সকালবেলা মালখাম্বা শিখতাম গুরুজীর কাছে। তারপর দশটার পর থেকে শুরু হতো হাউসকিপিং এর কাজ, আবার বিকেলে প্র্যাকটিস চলছে।” এভাবেই কাটছিল মুম্বাইয়ের দিনগুলি। এরপর লুইস টেরেন্সের অ্যাড দেখে সেখানে যোগাযোগ করে। এক অডিশনেই কামাল। টেরেন্স বলে ওঠে এটাই চাইছিলাম। এরিয়াল অ্যাক্ট আরও ভালো করে শেখার পাশাপাশি সেখানে একটা এগ্রিমেন্ট করতে হয়েছিল ৫০ টা শোয়ের। আর তার বিনিময়ে দেড় বছরের ডিপ্লোমা পাওয়া যাবে। সেই সময় তাজ হোটেলে শাহরুখ খানের সাথে সুজুকি বাইক লঞ্চ করা থেকে শুরু করে বিরাট বড় বড় শো করেছে মানিক। ততদিনে বিভিন্ন শো করে রোজগার নেহাৎ মন্দ হতো না।
এমন সময় কালার্স টিভি থেকে ‘ইন্ডিয়ান গট ট্যালেন্ট’ অডিশন দেয় মানিক। সেটা সিজন থ্রি হবে, কিন্তু চান্স পায়না। টেরেন্স কাছে নাচ শেখা চলতে থাকে। ২০১৫ তে আবারও অডিশন দেয় সিজিন সিক্সএ। ইন্ডিয়াস গট ট্যালেন্টের গ্র্যান্ড ফিনালেতে এরিয়াল ডান্সার মানিক চাম্পিয়ান হলে সেদিন যেন নিজে বিশ্বাস করতে পারছিল না। হাতে ৫০ লাখ টাকার চেক, গাড়ি, আরো আরো কত কিছু। এবার চুক্তি কালার্স এর সঙ্গে। তাদের হয়েও বহু শো করেছে মানিক। ইন্ডিয়াস গট ট্যালেন্ট জেতার পর মুম্বাই থেকে প্রথম আসে পিলখানা মামাবাড়িতে। এরপর আসামের বড়পেটা রোডে মায়ের কাছে। মা তখনো চায়ের দোকান চালিয়ে যাচ্ছে। আসামে গেলে প্রশাসন থেকে শুরু করে সাধারণ মানুষ সকলের অভিনন্দন ও শুভেচ্ছার জোয়ারে ভাসে সে। মানুষের ভিড় আছড়ে পরেছিল সেই ভাঙা বাড়িতে। মানিক ঠিক করল আসামে ডান্স ক্লাস খোলার। ২০১৬ সালে আসামে প্রথম ডান্স শেখানোর ক্লাস খোলা হলে সেখানে ভিড় লেগে যায় ছাত্রছাত্রীর। এরপর ২০১৭ তে কোচবিহারে জমি কিনে বাড়ি করে। আসাম থেকে দাদা, মা সকলকে নিয়ে চলে আসে কোচবিহারের বাড়িতে।
মুম্বাইতে ততদিনে চল ছেড়ে দিয়ে দাদারে সিদ্ধি বিনায়ক মন্দিরের সামনে একটা বড় ফ্ল্যাট ভাড়া করে থাকা শুরু করেছিল মানিক। বেশ কিছু ছাত্র ছাত্রীদের শেখানোও শুরু করে সে। আর সেখানে যারা এরিয়াল অ্যাক্ট শিখতে আসত সেরকম কিছু শিক্ষার্থীকে নিখরচায় থাকার সুযোগ করে দিয়েছিল নিজের ওই ফ্ল্যাটে। মানিকের কথায়, ‘ওদের দেখলে আমার পুরনো দিনগুলো মনে পড়ে যেত। আমাকে অনেকে এভাবে সাহায্য করেছিল আমার অসময়ে। তাই যতটুকু পেরেছি ওদের সাহায্য করেছি।’ এভাবেই সময় চলছিল।
এরপর এলো করোনা কাল। সে সময় প্রায় সব কিছুই অনলাইন। শো বন্ধ। মুম্বাইতে থাকাটা সে সময় খুব অসুবিধা জনক হয়ে যাচ্ছিল। সেই অবস্থায় কোচবিহারের বাড়িতে ফিরে এলো মানিক। বাড়িতে কিছু করার নেই, অত বড় জায়গাও নেই যেখানে সে এরিয়াল অ্যাক্ট প্র্যাকটিস করতে পারে। অনেক কিছু চিন্তা করে কোচবিহার শালবাগানেই নিজের প্র্যাকটিসের জায়গা ঠিক করে নিল। প্রত্যেক দিন সকালে উঠে চলে যেত শালবাগানে। উঁচু গাছে উঠে প্র্যাকটিস করতো এরিয়াল অ্যাক্ট, আবার বাড়িতে চলে আসা, খাওয়া, ঘুম। এভাবেই দিন কাটছিল। এরপর করোনার দ্বিতীয় পর্যায়ে কোচবিহারে খুলল মানিক পাল ডান্স একাডেমী। লকডাউনের সময় আসামের ডান্স স্কুলটা বন্ধ হয়ে যায়। এখন আবার তা খোলার তোড়জোড় চলছে। কোচবিহারের ডান্স স্কুলে আশির ওপরে ছাত্র-ছাত্রী। এছাড়াও কলকাতার টলিউডে প্রচুর শোতে মানিক পাল খুব পরিচিত একটি নাম। টিভি খুললেই আজকাল দেখা যায় ডান্স শোয়ের মধ্যমনি হিসাবে মানিক পালকে। দেশে বিদেশে শো বাদে, প্রচুর ওয়ার্কশপের জন্য ডাক পায় বলে জানালো মানিক। আজকাল এই ফিল্ডে যাদের নাম উঠে আসছে বিহারের বিট্টু আকাশ সিং, কলকাতার লাইলী তরফদার, আকাশ হেলা, গৌহাটির ধনঞ্জয় এরা সকলেই মানিক পালের ছাত্র। এদের ভালো জায়গায় পারফর্ম করতে দেখলে গর্বে বুক ভরে যায়, জানালেন মানিক।
এবারের টার্গেট কোচবিহার থেকে কিছু ট্যালেন্টকে তুলে ধরা সকলের সামনে। আর সেই ইচ্ছাকে কাজে লাগিয়ে আগামী ৬ ৭ ৮ স্থানীয় গল্পোতে একটি ডান্স ওয়ার্কশপ করা হবে। শুধু মুম্বাই থেকে তাই জন্য নিয়ে আসা হয়েছে নামি কোরিওগ্রাফার নীরজ লোহানি ও রেশমা শর্মাকে। নয় তারিখ প্রোগ্রাম করতে আসছেন কলকাতার নামী অভিনেত্রী ও নৃত্যশিল্পী দেবলীনা দত্ত। স্থানীয় রবীন্দ্রভবন মঞ্চে এদের সবাইকে নিয়ে তার মানিক পাল স্টুডিওর বাৎসরিক অনুষ্ঠান করা হবে বলে জানালেন তিনি। ওই দিন ওয়ার্কশপে যারা যোগ দিয়েছিল, সকলকে নিয়েই প্রোগ্রাম করা হবে। মাত্র চার মাস হল বিয়ে করেছেন মানিক। তার কথায় জীবনের লক্ষ্য ছিল মাকে একটা বাড়ি করে দেওয়ার। সেটুকু করতে পেরেছি। আর বাকিটা তো সময় বলবে। তবে মাটির কাছাকাছি ছিলাম, সারা জীবন মাটিতেই যেন আমার পা দুটো থাকে, এটাই চাওয়া।
শত ব্যস্ততার মধ্যেও নিজের ডান্স একাডেমীর দিকে তীক্ষ্ণ নজর মানিকের। আর্থিক ভাবে পিছিয়ে পরা, কিন্তু ইচ্ছে ও প্রতিভা দুইই আছে এমন শিক্ষার্থীদের জন্য বিনে পয়সায় শেখাতে প্রস্তুত সে। কঠোর পরিশ্রম, হার না মানার মানসিকতা, জেদ আর ইচ্ছাশক্তির কাছে কোনো কিছুই যে অসম্ভব নয়, কোচবিহারের মানিক পাল তার জ্বলন্ত উদাহরণ।